- উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতি?
মানব জাতির ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ই নভেম্বর জার্মানি যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষর করলে মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে। বিশ্বে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্যারিস সম্মেলনে পাঁচটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে জুন জার্মানির সঙ্গে মিত্রশক্তির ভার্সাই সন্ধি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক বিতর্কিত চুক্তি। প্যারিস সম্মেলন ছিল একটি বিশ্ব সম্মেলন, এখানে স্বাক্ষরিত সন্ধিচুক্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হল উইলসনের আদর্শবাদ। উইলসন বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হওয়ার জন্য তিনটি কারণকে প্রধানত দায়ী করেন—গোপন কূটনীতি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র। এর মধ্যে গোপন কূটনীতি বলতে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধকালীন কূটনীতিকে ধরা হয়। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্টি হয় তিক্ততা, যার মধ্যে নিহিত থাকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের বীজ, সাম্রাজ্যবাদের ফলে জাতীয়তাবাদের হয় চরম অবমাননা। প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই প্রতিষ্ঠিত ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র। ফলে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার ব্যাহত হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসন এই বিচ্যুতি দূর করার জন্য তিনটি বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন করেন—
(১) গোপন কূটনীতির পরিবর্তে মুক্ত ও আলাদা-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং বিবাদের মীমাংসা করা।
(২) জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার এই আদর্শ নিয়ে প্রত্যেক জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে হবে। এক জাতি, এক রাষ্ট্র—এই নীতি অনুসরণ, স্বাধীনতা ও সমতার ভিত্তিতে সমস্ত পদানত জাতিকে মুক্ত করে তাদের পৃথক রাষ্ট্রে মত দিয়ে জাতীয়তাবাদের জয় ঘোষণা করতে হবে।
(৩) প্রত্যেক দেশে রাজনীতিকে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্রের। রাষ্ট্রকে উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও মুক্তপন্থী করে তুলতে হবে। উপরিউক্ত তিনটি উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য উইলসন তাঁর বিখ্যাত চৌদ্দ তফা শর্ত ঘোষণা করেন। এই উল্লেখযোগ্য ধারাগুলি হল—
(i) গোপন কূটনীতি পরিত্যাগ করে খোলাখুলিভাবে এবং সমতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করা। (ii) শান্তি বা যুদ্ধের সময় উপকূলবর্তী অঞ্চল ব্যাতীত সমূদ্র মুক্ত রাখা।
(iii) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক বাধাবিঘ্ন হ্রাস করা।
(iv) আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়োজন ব্যতীত অস্ত্রশস্ত্রের হ্রাস।
(v) উপনিবেশবাসীর স্বার্থের কথা স্মরণ রেখে আলাদা আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপনিবেশ পুনর্বিবেচনা করা।
(vi) রাশিয়ার হৃত রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দিয়ে তাকে স্বাধীন দেশ রূপে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া।
(vii) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেলজিয়ামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
(viii) অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিকে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ দান।
(ix) বলকান অঞ্চলের পুনর্গঠন
(x) তুরস্ক সাম্রাজ্যের অমুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দান ও
(xii) ক্ষুদ্র ও বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও রাজ্যসীমার একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন।
0 Comments